পর্ব-২
 |
Photo Credit: inkhammer.wordpress.com |
সাপ সম্পর্কে কত রকম কুসংস্কারই না
চালু আছে আমাদের মাঝে । সাপুড়েরা নানারকম আষাঢ়ে গল্প করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে নিয়মিত । বীণ বাজালে সাপ ছুটে আসে একথা বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই । মালাবার পাহাড়ের
পাদদেশে বসবাসকারী লোকেরা বিশ্বাস করে যে, পুরুষ সাপ সতী ও যুবতী মেয়েদের প্রেমে
পড়ে যায়। একবার প্রেমে পড়লে ঐ সাপের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া দুষ্কর। ঐ সাপেরা তাদের
প্রেমিকাদের দংশন করেনা। তাই, এখানকার লোকেরা যুবতী মেয়েদের ঝোপ-ঝাড়ের আশেপাশে
যেতে দেয়না। সাপ নিয়ে কুসংস্কার বিষয়ে আমার শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নুরজাহান সরকারের লিখা প্রবন্ধে যেসব
কুসংস্কার নিয়ে লিখেছেন তা হলো-
সাপের মাথায়
মণি আছে!
সাপের মাথায় মণি আছে বলে গ্রামগঞ্জে, চলচ্চিত্রে যে গল্প প্রচলিত আছে তা ভিত্তিহীন।
সাপের মাথায় কোনো মণি নেই বা মণি থাকার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। সাপ তার জীবদ্দশায়
প্রথম দিকে ঘন ঘন এবং পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট সময় পর পর খোলস বদলায়। এই খোলস সারা
শরীর থেকে খুলে গেলেও মাথার দিকে কিছুটা আটকে থাকে এবং আস্তে আস্তে সেটা শুকিয়ে
শক্ত হয়ে খাড়া অবস্থায় রূপ নেয়। এই খোলসে চাঁদনি রাতের আলো কিংবা যে কোনো আলো পড়লে
চকচক করে ওঠে। এটা থেকেই সাপের মাথায় মণির ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
 |
Photo Credit: http://hchm.org |
সাপ কখনোই দুধ খায় না। সাপের মুখের
গঠন দুধ খাওয়ার উপযোগী নয়। এটি একেবারেই মানুষের তৈরি ভুল ধারণা ও অপপ্রচার। সাপ নানা প্রকার পোকামাকড় ও ইঁদুর খেয়ে ফসল সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। কোনো কোনো সাপ শুধু সাপই খায়, যেমন- রাজগোখরা।
সাপ নিজের
বিষ নিজে শোষণ করে!
সাপ নিজের বিষ শোষণ করার কোনো প্রশ্নই
আসে না। এ ধারণার জন্ম দিয়েছে সাপুড়েরা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে লোকজনের অজ্ঞানতার
সুযোগে একচেটিয়া ব্যবসা গড়ে তুলেছে তারা। এদেরকে ওঝা বলা হয়। সাপে কাটা রোগীর জন্য
মানুষ তাদের ডেকে আনে এবং এসব ওঝারা এমন ভাব দেখায়, যেন যে সাপে কামড় দিয়েছে সে সাপটিকে এনেই বিষ শোষণ
করাবে। এজন্য আসার সময় অনেক দিনের ক্ষুধার্থ সাপ রোগীর বাড়ির কাছাকাছি কোনো ঝোপে
ছেড়ে দিয়ে আসে। (সাপ মাসের পর মাস না খেয়ে বাঁচতে পারে, তবে
দুর্বল হয়ে পড়ে) এরপর রোগীর বাড়িতে এসে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করে
এবং বলে, সাপ বাড়ির কাছে এসে গেছে। এমন ভাব দেখায়,
যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং একসময় ঝোপে হাত দিয়ে সাপ বের করে নিয়ে আসে।
মানুষ সাপুড়ের এই বাহাদুরিতে মুগ্ধ হয়।
সাপের পা যে
দেখবে সে রাজা হবে!
আসলে সাপের কোনো পা নেই। সুতরাং রাজা
হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। এটি অপকথন ছাড়া আর কিছুই নয়। সাপের পা দেখার জন্য কিছু
অবুঝ লোক কিংবা কোনো শিশু ঝোপঝাড়ে যেতে পারে। এতে সাপে কামড়ানোর আশংকা বেড়ে যেতে
পারে।
তন্ত্রমন্ত্র!
ওঝার তন্ত্রমন্ত্র বলে যে কথন রয়েছে, তা ভিত্তিহীন। ওঝা সাপ ধরার জন্য যে ক্ষমতা
দেখায় বা সাপের বিষ নামানোর জন্য যে ভাবভঙ্গি করে, তা তন্ত্রমন্ত্রভিত্তিক
নয়। ওঝা সাপ ধরার ব্যাপারে যে বিশেষজ্ঞ, এতে কোনো সন্দেহ
নেই। সে বিড়বিড় করে ঠিকই, তবে লোক দেখানো। আসলে এরা
বংশপরম্পরায় সাপ ধরার কৌশল রপ্ত করে।
 |
Photo Credit: www.popsci.com |
বাঁশির সুরের
তালে তালে সাপ দোলে!
বাঁশির কোনো সুরই সাপ শোনে না।
সাপুড়েরা বাঁশি বাজানোর তালে তালে মাঝে মধ্যে মাটিতে আঘাত করায় কম্পনের ফলে সাপের
অনুভূতি সজাগ থাকে। বাঁশির এদিক-ওদিক দোলানোর ভঙ্গি দিয়ে সাপুড়ে এক আবহ তৈরি করে
মানুষকে মুগ্ধ করে। যে সাপ নিয়ে তারা খেলা দেখায় তার সবই প্রায় বিষধর। এতে দর্শকের
কাছে সাপুড়েরা বাঁশির বিষয়টিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এসব
সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফেলায় এরা বিষ প্রয়োগ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাই এটা সম্ভব হয়।
 |
Photo Credit: http://www.lightnfocus.com |
সাপ ও বেজির যুদ্ধে বেজি পাতা দিয়ে
বিষক্রিয়া নষ্ট করে!
সাপ ও বেজির সম্পর্ক ভালো নয়। কারণ
বেজি সাপ খায়, বিশেষ করে সাপের
বাচ্চা। বেজি প্রধানত প্রচুর ইঁদুর ও পোকামাকড় খায়। সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও এর জুড়ি
নেই। সাপ যখন প্রথমে মাথা তুলে বেজিকে আক্রমণ করে, তখন
বেজি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সাপকে আক্রমণ করে। সাপ যতবার কামড় দিয়ে বিষ ঢালে, ততবারই তা বেজির খাড়া লোমের ওপর গিয়ে পড়ে। বেজি কৌশলে চট করে ঝোপে
লুকিয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে আসে। ইতিমধ্যে সাপ মাথা নামায় এবং বেজি
এসেই সাপের মাথা কামড়ে ধরে। বেজির ঝোপে ঢোকার কারণে মানুষ মনে করে সে এক প্রকার
পাতা কামড়ের স্থানে ছুঁইয়ে আসে, যে পাতা সাপের বিষ থেকে
বেজিকে বাঁচায়। আসলে এর কোনো সত্যতা নেই।
সাপ
প্রতিশোধপরায়ণ!
সাপ ইঁদুরকে কামড় দিয়ে তাকে খাওয়ার
জন্য খুঁজতে থাকে। ইঁদুর সাপের কামড়ে আশপাশেই অবশ হয়ে পড়ে থাকে। সাপ ইঁদুরটি খুঁজে
বের করে খায়। এ দৃশ্য দেখে মানুষ অনুমান করে নিয়েছে, সাপকে কেউ ব্যথা দিলে সে কামড়াবেই। এটা পুরোপুরি সত্য
নয়।
সাপুড়েদের
মৃত্যু সাপের হাতে!
অসাবধানতায় সাপুড়ের সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। সাপুড়েরা জানে, সাপের বিষদাঁত
ভেঙে দিলে আর কোনো ভয় নেই। কিন্তু এটা জানে না যে, বিষদাঁত
ভাঙলেও আবার তা গজায়।
বিঃদ্রঃ এসব নিছকই কুসংস্কার।
সংকলনেঃ মোঃ আব্দুস সামাদ, সাবেক শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাবি।
চলবে................